মানুষ রূহ বা আত্মা এবং দেহের সমন্বয়ে গঠিত। একটি অপরটি ছাড়া অচল। মানুষের দেহ কেবল মাত্র এই দুনিয়ার জীবনের জন্য। কিন্তু মানুষের রূহ বা আত্মা আখেরাতের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট। বিশ্ব খ্যাত গবেষক আল-ফারাবীর মতে "রূহ বা আত্মা হলো এমন বস্তু যার উপর মানুষের জীবন নির্ভরশীল"।
যুগশ্রেষ্ঠ দার্শনিক ইমাম গাযযালী (রহ) বলেন- "রূহ বা আত্মা হলো মানুষের দেহ সংশ্লিষ্ট এবং দেহোত্তীর্ণ আধ্যাত্মিক সত্তা"। রূহ বা আত্মা এটি অত্যন্ত হালকা দেহযুক্ত একটি সত্তা। রূহ বা আত্মা এমন এক বিষয় যা চিরন্তন। অমর, অবিনশ্বর, অদৃশ্য এবং সর্বত্র বিরাজমান এবং যা মানুষের প্রাণ শক্তিকে সঞ্চারিত করে। যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই।
রূহ বা আত্মা শরীরের সাথে সংযুক্ত অত্যন্ত হালকা শরীর, দেহ ও আত্মা একে অপরের প্রতিপক্ষ। রূহ বা আত্মা একটি রূপ যা আমাদের কাছে কল্পনা করা যায় না, কারণ এই পৃথিবী থেকে এতে কিছুই নেই। দেহের সাথে এর সংযোগ। মানব গবেষক আবুল হায়সাম বলেন- "রূহ বা আত্মা এমন বিষয় যার মাধ্যমে মানুষ শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ করে। যা মানুষের ভেতর হতে বের হয়ে গেলে মানুষ মারা যাবে"। অর্থাৎ শ্বাস প্রশ্বাসের নাম হায়াত বা জীবন।
দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিকদের মতে, রূহ আত্মা তিন ধরনের হয়। যথা- ১. রূহে হায়াতীঃ এ রূহ বা আত্মার অবস্থান হৃদপিণ্ডে এর সাথে মানুষের জীবন এবং তার স্বস্তি ও সুস্থতা সম্পর্কিত। ২. রূহে তবয়ীঃ এ রূহ বা আত্মার অবস্থান রক্ত, এ রূহ বা আত্মা মানুষের শক্তি, সামর্থ্য এবং কর্মক্ষমতা সংশ্লিষ্ট। ৩. রূহে নাফসানীঃ এ রূহ বা আত্মার অবস্থান মাথা। এই রূহ হলো অনুভূতি এবং চেতনার মূল।
বাংলা ভাষায় 'রূহ' কে আত্মা বলে। আরবিতে কখনো 'কলব' কখনো 'নাফস' ব্যবহার হয়েছে। রূহ বা আত্মা বিষয়ক আলোচনা পবিত্র কুরআনে একাধিক বার উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন- " অতঃপর যখন তাকে ঠিকঠাক করে নেব এবং তাতে আমার রূহ থেকে ফুঁক দেব,তখন তোমরা তার সামনে সেজদায় পড়ে যেয়ো। -(সূরা হিজর-১৫ঃ২৯)।
মানবদেহে আত্মা সঞ্চারিত করাঃ রূহ (আত্মা) কোন যৌগিক, না মৌলিক পদার্থ - সম্পর্কে পন্ডিত ও দার্শনিকদের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকেই মতভেদ চলে আসছে। ইমাম গাযযালী, ইমাম রাযী এবং অধিক সংখ্যক সূফী ও দার্শনিকদের উক্তি এই যে, রূহ কোন যৌগিক পদার্থ নয়, বরং একটি সূক্ষ্ম মৌলিক পদার্থ। কিন্তু অধিকাংশ আলেমের মতে রূহ একটি সূক্ষ্ম দেহবিশিষ্ট বস্তু। তাই রূহ বা আত্মাকে ফুঁক দেয়া অথবা সঞ্চার করার অর্থ হবে দেহের সাথে তার সম্পর্ক স্হাপন করা। -(বয়ানুল কুরআন)।
কাযী সানাউল্লাহ পানিপথী (রহঃ) তাফসীরে মাযহারীতে লিখেছেনঃ রূহ বা আত্মা দুই প্রকার- স্বর্গজাত ও মর্ত্যজাত। সর্গজাত রূহ আল্লাহ তা'আলার একটি একক সৃষ্টি। যা আদেশ জগতের সূক্ষ্ম তত্ত্ব। আল্লাহ তা'আলা বলেন- তারা আপনাকে 'রূহ' সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দিনঃ রূহ আমার পালনকর্তার আদেশঘটিত। এ বিষয়ে তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে। -(সূরা বনী ইসরাঈল-১৭ঃ৮৫)।
রূহ বা আত্মা (প্রাণ যার বদৌলতে জীবন কায়েম রয়েছে) জৈব রূহ। অর্থাৎ রূহ সাধারণ সৃষ্টজীবের মত উপাদানের সমন্বয় এবং জন্ম ও বংশবিস্তারের মাধ্যমে অস্তিত্ব লাভ করেনি ; বরং তা সরাসরি আল্লাহ তা'আলার আদেশ (হও) দ্বারা সৃজিত। রূহ সম্পর্কে এতটুকু জ্ঞান মানুষের জন্য যথেষ্ট। এর বেশী জ্ঞানের উপর তার কোন ধর্মীয় অথবা পার্থিব প্রয়োজন আটকা নয়।
মর্ত্যজাত রূহ হচ্ছে ঐ সূক্ষ্ম বাষ্প, যা মানবদেহের চার উপাদান অগ্নি, পানি, মৃত্তিকা ও বায়ু থেকে উৎপন্ন। এই মর্ত্যজাত রূহকেই নফস বলা হয়। মর্ত্যজাত রূহ তথা নফস স্বর্গজাত রূহ থেকে প্রাপ্ত গুণাগুণ ও প্রতিক্রিয়াসহ সর্বপ্রথম মানবদেহের হৃৎপিণ্ডের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়। এ সম্পর্কের নাম হায়াত বা জীবন। মর্ত্যজাত রূহ সমগ্র দেহে বিস্তৃত সূক্ষ্ম শিরা-উপশিরায় সংক্রামিত হয়। এভাবে সে মানবদেহের প্রতিটি অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
মানবদেহের মর্ত্যজাত রূহের সংক্রামিত হওয়াকেই আত্মা ফুঁকা বা আত্মা সঞ্চারিত করা বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা রূহকে নিজের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করে বলেছেন, যাতে সমগ্র সৃষ্টজীবের মধ্যে মানবাত্মার শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে উঠে। কারণ মানবাত্মা উপকরণ ব্যতীত একমাত্র আল্লাহর আদেশেই সৃষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া তার মধ্যে আল্লাহর নূর গ্রহণ করার এমন যোগ্যতা রয়েছে, যা মানুষ ছাড়া অন্য কোন জীবের আত্মার মধ্যে নেই।
মানব সৃষ্টির মধ্যে মৃত্তিকাই প্রধান উপকরণ। এ জন্যেই কুরআন মানব সৃষ্টিকে মৃত্তিকার সাথে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে মানবসৃষ্টির উপকরণ দশটি জিনিসের মধ্যে পরিব্যাপ্ত। তন্মধ্যে পাঁচটি সৃষ্টি জগতের এবং পাঁচটি আদেশ জগতের। সৃষ্টি জগতের চারটি উপাদান আগুন, পানি, মাটি,বাতাস এবং পঞ্চম হচ্ছে এ চার থেকে সৃষ্ট সূক্ষ্ম বাষ্প যাকে মর্ত্যজাত রূহ বা নফ্স বলা হয়। আদেশ জগতের পাঁচটি উপকরণ কলব,রূহ,সির,খফী ও আখফা। এগুলো আদেশ জগতের সূক্ষ্ম তত্ত্ব।
মালাকুল-মউত বা ফেরেশতাগণের দ্বারা রূহ বা আত্মার বিয়োগ ঘটানো কেবল মানুষের জন্য নির্দিষ্ট শুধুমাত্র তার মর্যাদার দরুন-অন্যান্য জীব-জন্তু আল্লাহর অনুমতিক্রমে ফেরেশতাগণের মাধ্যম ব্যতীত আপনা-আপনিই মৃত্যুবরণ করে।-(তাফসীরে কুরতুবী)। জীব-জন্তুর মৃত্যু মালাকুল -মউতের উপর ন্যস্ত নয়।-(মাযহারী)। কারো রূহ বা আত্মা বের করে নিয়ে আসার নির্দেশ প্রদানের পূর্ব পর্যন্ত মালাকুল- মউত কারো মৃত্যুক্ষণ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। -(তাফসীরে মাযহারী)।
রূহ(সোল) বা আত্মা যা দেহকে বিদায় দেয় দুই প্রকারের, ছোট মৃত্যু- প্রথমটিকে ঘুম (নিদ্রা) বলা হয়। মৃত্যুর ঘুমন্ত অবস্থায় ঘটে যাওয়া এবং তার পরে আসল মৃত্যু বা বড় মৃত্যু। উভয় অনুষ্ঠানে, রূহ বা আত্মা শরীর ছেড়ে চলে যায়। আল্লাহ তা'আলা বলেন - আল্লাহ মানুষের প্রাণ হরণ করেন তার মৃত্যুর সময়, আর যে মরে না, তার নিদ্রাকালে।অতঃপর যার মৃত্যু অবধারিত করেন, তার প্রাণ ছাড়েন না এবং অন্যান্যদের ছেড়ে দেন এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। -(সূরা যুমার-৩৯ঃ৪২)।
নিদ্রার সময় মানুষের প্রাণ তার দেহ থেকে বের হয়ে যায়, কিন্তু প্রাণের একটি রেশ দেহে বাকী থাকে। ফলে মানুষ জীবিত থাকে। এ রেশের মাধ্যমেই সে সপ্ন দেখে। নিদ্রাবস্হায় প্রাণ দেহ থেকে বেরিয়ে যায় ; কিন্তু জাগরণের সময় এক নিমেষের চেয়েও কম সময়ে দেহে ফিরে আসে।
প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের আছে হায়াত (জীবন) রূহ (আত্মা) এবং নাফস (স্ব) যখন ঘুমায় তখন নফসকে রূহ বা আত্মা গ্রহণ করে না। যার সাথে তিনি এখনও স্বাস নেন। ঘুমের মধ্যে ইন্তেকাল করলে তার নফসকে সেখানে নিয়ে যান। নফস এই পৃথিবী ছাড়া আর কিছুই চায় না। কিন্তু তার রূহ বা আত্মা কেবল তার পালনকর্তার সাথে দেখা করতে চায়।
সত্যই যখন রূহ বা আত্মা গ্রহণ করা হয় তখন দৃষ্টি শক্তি তা অনুসরণ করে। দৃষ্টি তার নফসের অনুসরণ করে। -(মুসলিম শরীফ)। পবিত্র কুরআনে রূহ বা আত্মার তিন প্রকারের বৈশিষ্ট্য বোঝাতে তিনটি ভাগ করা হয়েছে- যথা- আম্মারা (মন্দ কাজের আদেশদাতা), লাওয়ামা (মন্দ কাজের জন্যে তিরস্কারকারী ও মন্দ কাজ থেকে তওবাকারী) এবং মুতমাইন্না (প্রশান্ত ও নিরুদ্বেগ মন)।
১.আম্মারাঃ এ ধরনের নফসের অধিকারীগণ খারাপ চিন্তা করে ও খাবার কাজে লিপ্ত হয়। সাধারণত এরা কাফের শ্রেণীর লোকজন।২.লাওয়ামাঃ এজাতীয় নফসের লোকজন মন্দকর্মের চিন্তা করলেও তা বাস্তবায়ন করে না। এরা হলেন সাধারণ মু'মিন, মুসলিমগন। এবং ৩. মুতমাইন্নাঃ যাঁরা খারাপ কাজ করাতো দূরের কথা খারাপ কাজের চিন্তাও কোন সময়ে করেন না। এরা হলেন আল্লাহ তা'আলার প্রিয় বান্দা ওলী-আউলিয়া এবং নবী রাসূলগণ।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিয়ামতের দিনের নাজাতকে অন্তরের সঠিকতা, সততা এবং পরিচ্ছন্নতার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ " যে দিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না। সে দিন উপকৃত হবে শুধু সে, যে আল্লাহ তা'আলার নিকট আসবে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে।" -( সূরা শুআ'রা- ২৬ঃ৮৮-৮৯)।
রূহ বা আত্মাকে আত্মশুদ্ধ করার একটি বিশেষ পদ্ধতি আছে। যাকে আরবী ভাষায় বলা হয় 'তাযকিয়াতুন নাফস' যার বাংলা 'আত্মশুদ্ধি' বা অপবিত্র আত্মাকে পবিত্র করা, উন্নত করা। প্রকৃত পক্ষে আত্মশুদ্ধি ছাড়া কখনো একটি মানুষ নিঃস্বার্থ, নির্লোভ, দুনিয়া বিমুখ ভালো মানুষ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
লেখকঃ খতীব, আব্দুচ্ছালাম বাগেরহাটী, পিলখানা, ঢাকা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন