মাযহাব শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো পথ। পরিভাষায় মাযহাব হলো ইসলামী শরীআতের ব্যাপারে দালায়েল (প্রমাণ) এর ভিত্তিতে মুজতাহিদ (গবেষক) কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যা। তাকলীদ হলো মুজতাহিদ কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যা অনুসরণ, মুকাল্লিদ অর্থ হলো অনুসারী।
মাযহাব কেন প্রয়োজন? যেহেতু কুরআন মাজীদ ও হাদীস শরীফ প্রত্যেকে নিজে সরাসরি সঠিকভাবে বুঝে আমল করা সম্ভবপর নয় তাই মাযহাব প্রয়োজন। যেমন কুরআনে কারীমে বলা হয়েছে- "তোমরা না জানলে জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস কর"। (সূরা নাহল-১৬, আয়াত-৪৩) সুতরাং যিনি কুরআন মাজীদ ও হাদীস শরীফ নিজে বুঝে আমল করবেন তিনি মুজতাহিদ, আর যিনি অন্যের কাছে শুনে বা অন্যকে দেখে আমল করবেন তিনি মুকাল্লিদ।
আমরা কেন মাযহাব অনুসরণ করি? যেহেতু আমারা কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফ হতে মাসআলা ইস্তিম্বাত ও ইজতিহাদ করতে পারি না তাই মাযহাব অনুসরণ করি। সুতরাং এটাই আমাদের মাযহাব অনুসরণের প্রথম কথা ও শেষ কথা। কেননা মুকাল্লিদ বা মুজতাহিদ হওয়া ছাড়া তৃতীয় কোন পথ নেই। কারণ সকল মানুষ যেমন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হওয়া সম্ভবপর নয় তেমনি সকল মানুষ মুজতাহিদ হওয়াও অসম্ভব ব্যাপার।
ইমাম বুখারী (রহঃ), ইমাম মুসলিম (রহঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রহঃ) সহ বড় বড় মুহাদ্দিসগণ মুজতাহিদ ছিলেন। তাই তাদের কাউকে মানলেও মাযহাব মান্য করা হয়। মাযহাব সংখ্যাও অনেক কিন্তু সব মাযহাব ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়নি যার কারণে চারটি মাযহাবই প্রসিদ্ধ লাভ করেছে, (১) হানাফী, (২) শাফেয়ী, (৩) মালেকী, (৪) হাম্বলী।
হানাফী মাযহাবের ফযীলত (শ্রেষ্ঠত্ব) হলো এই চার ইমামের মধ্যে একমাত্র ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) হলেন তাবেয়ী, আর বাকী তিন জন হলেন তাবে তাবেয়ী। দ্বিতীয়ত বর্তমানে পৃথিবীতে ৮০% মুসলিমই হানাফী মাযহাব অনুসারী।
একটি প্রশ্নের উত্তরঃ অনেকে বলেন-ইমাম আবূ হানিফা (রহঃ) বলেছেন -" ইযা সাহ্হাল হাদীসু ফা হুওয়া মাযহবী" (কোন হাদীস সহীহ প্রমাণ হলে তাই আমার মাযহাব)। সুতরাং বলা যায় যে তিনি তার মাযহাব অনুসরণ করতে বলেননি বরং সহীহ হাদীস অনুসরণ করতে বলেছেন। তাই যারা মাযহাব না মেনে হাদীস অনুসরণ করে তারাই সঠিক পথে আছে।
উত্তরে আমরা বলবো- একই বিষয়ে যদি একাধিক (বিপরীতমুখী) সহীহ হাদীস থাকে তবে আমরা কোনটি আমল করবো? এর জন্য প্রয়োজন মুজতাহিদ কর্তৃক প্রদত্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাখ্যা। আর এসবের সঠিক ব্যাখ্যার জন্য প্রয়োজন আসার (সাহাবীগনের জীবন) সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান। যেহেতু সাহাবীগণের কথাও দলীল। বুখারী শরীফ (পৃষ্ঠা ১০৬, পরিচ্ছেদ ১২০)। অনুরূপ তাবেয়ীগণের আমলও দলীল। বুখারী শরীফ (পৃষ্ঠা ১০৮, পরিচ্ছেদ ১২৪, হাদীস ১৬৬/ পরিচ্ছেদ ১২৮)।
ইসলামী শরীআতের মূল উৎস হলো চারটিঃ (১) কুরআন, (২) হাদীস, (৩) ইজমা ও (৪) কিয়াস। সাহাবায়ে কিরাম ইজমার উপর আমল করার চেষ্টা করতেন। বুখারী শরীফ (পৃষ্ঠা ১১৪, হাদীস ১৭৯)। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ইমাম বুখারী (রহঃ) মাসআলা বয়ান করে তার অধিনে দলীল হিসেবে বিভিন্ন ছাহাবী ও তাবেয়ীগণের বাণী ও কর্ম উপস্থাপন করেছেন। বুখারী শরীফ (পৃষ্ঠা ১১৩, পরিচ্ছেদ ১৩০)। আর ইমাম আবু হানিফা ( রহঃ) যেহেতু নিজেই তাবেয়ী তাই তাঁর কথাই দলীল হিসেবে গণ্য।
বুখারী শরীফ কোন সাধারণ হাদীস গ্রন্থ নয়, বরং এটি বুখারী মাযহাবের ফেক্হ এর কিতাব, যাতে তিনি তার মাযহাবের দলীল পেশ করেছেন। তাই যারা বুখারী শরীফে বা অন্য মাযহাবের কিতাবে হানাফী ফিকহের দলীল খোঁজেন, তাদের জানা দরকার যে, আসলে ঐটা ভিন্ন মাযহাবের কিতাব। সুতরাং হানাফী মাযহাবের দলীল সেসব কিতাবে পাওয়া যাবে না, যেমন অন্য মাযহাবের দলীল হানাফী মাযহাবের কিতাবে পাওয়া যাবে না। তাই হানাফী ফিকহের দলীল হানাফী মাযহাবের কিতাবেই খুজতে হবে। (যেমন, শারহে মাআনিয়ুল আছার - তহাভী শরীফ, মুসনাদে ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) ইত্যাদি)।
সুতরাং আমরা বলবো- ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) সহ সকল ইমামগণই সহীহ হাদীসের উপর আমল করেছেন, অর্থাৎ তাঁরা যা আমল করেছেন সবই সহীহ হাদীস মোতাবেক ছিলো, কেননা সহীহ্ হাদীস বলতে শুধুমাত্র বুখারী শরীফ ও মুছলিম শরীফসহ ছিহাহ ছিত্তাকেই বুঝায় না, বরং এগুলো ছাড়াও ছহীহ হাদীসের বহু কিতাব বিদ্যমান রয়েছে। যেমন- মুয়াত্তা ইমাম মালিক (রহঃ) এর সনদকে বলা হয় "সিলসিলাতুযযাহাব" (স্বর্ণ শিকল) যাতে বর্ণনাকারীর সংখ্যা তিন, আর বুখারী শরীফের সনদকে বলা হয় " সিলসিলাতুল ফিদদহ" (রূপার শিকল) যাতে বর্ণনাকারীর সংখ্যা পাঁচ।
হাদিসের দুটি অংশ থাকেঃ (১) মতন ও (২) সনদ। কোন হাদীসকে সহীহ, যয়ীফ, হাসান ইত্যাদি নাম করণ করা হয় তার সনদের উপর ভিত্তি করে। হাদীসের রাভী বা বর্ণনাকারীগণের গুণাগুণ দিয়ে মুহাদ্দিসীনে কিরাম হাদীসের সনদের বিচার -বিশ্লেষণ করেন। পূর্ব যুগের লোক পরবর্তী যুগের লোক অপেক্ষা উত্তম, বিশেষত প্রথম তিন শতাব্দী। যে সকল হাদীস পূর্ববর্তী ইমামগণ সহীহ পেয়ে ছিলেন সে সব হাদীসের অনেকগুলোই পরবর্তী বর্ণনাকারীর দুর্বলতার কারণে পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ গ্রহণ করননি।এর মানে এই নয় যে, পূর্ববর্তী ইমামগণ কোন দূর্বল হাদীস অনুযায়ী আমল করেছেন। এই সূত্রে বলা যায় কোন একটি হাদীস পরবর্তীগণ (সহীহ সনদে) না পেলে পূর্ববর্তীগণও তা ( সহীহ সনদে) না পাওয়ার পাওয়া প্রমাণ হয় না।
মুজাদ্দিদে আলফে সানী-শাঈখ আহমদ সেরহিন্দ (রহঃ) মুজতাহিদ পর্যায়ের আলিম হয়েও হানফী মাযহাব অনুসরণ করতেন, তিনি বলতেন মাযহাব অনুসরণ করা আমলের ক্ষেত্রে নিরাপদ পন্হা।
পরিশেষে আমরা বলবো-মাযহাব অনুসরণের বিকল্প নেই, আর হানাফী মাযহাব হলো শ্রেষ্ঠতম মাযহাব। সুতরাং আসুন আমারা নফসে আম্মারা ছেড়ে হানাফী মাযহাব অনুসরণ করি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন