রোযার দার্শনিক তাৎপর্য

বস্তুবাদ এবং ভোগবাদের চরম পাশবিকতার বেড়াজালে বন্দী মুমূর্ষু মানবতার মুক্তি বিধানের লক্ষ্যে আল্লাহ তা'আলার নির্দেশিত পথে যুগে যুগে প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন আল্লাহ তা'আলার প্রেরিত নবী ও রাসূলগণ। মানুষের দেহ, আত্মা ও মস্তিষ্ককে পূত-পবিত্র করেছেন সকল আবিলতা- পংকিলতা থেকে। সেই সাথে মানুষকে প্রস্তুত করেছেন তারই জীবনোদ্দেশ্য খেলাফতের দায়িত্ব পালন করা এবং আল্লাহ তা'আলার নির্দেশ বাস্তবায়ন করার জন্য। 



দেহ ও আত্মার মিলিত শক্তির সমন্বয়ে খিলাফতের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের লক্ষ্যে আল্লাহ তা'আলা নাযিল করেছেন রোযার বিধান, রমযান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমেই মানুষ তার অভ্যন্তরের পাশবিক শক্তি ও ভোগবাদী মানসিকতা দমন করতে সক্ষম হয় এবং নিজেকে আধ্যাত্মিক তরবিয়তের মাধ্যমে গড়ে তুলতে পারে একজন আনুগত্যশীল গোলাম হিসেবে। 



রোযার বিধান ফরজ হওয়ার মধ্যেই নিহত রয়েছে রোযার দার্শনিক দৃষ্টিকোণ। আল-কুরআনের ঘোষণা থেকেই এটি স্পষ্ট হয়ে উঠে। আল্লাহ তা'আলা বলেন, "হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমনটি ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, সন্দেহ নেই যে, তোমরা এতে মুত্তাকী হতে পারবে। -(সূরা বাক্বরা-২ঃ১৮৩)। 



উপরোক্ত আয়াত থেকে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, আত্মসংযম, উন্নত নৈতিক চরিত্র গঠন, আল্লাহরt স্মরণ ও খোদাভীতি অর্জনই রোযার অন্যতম উদ্দেশ্য। সুতরাং মানবজীবনে তাদের মাঝে পরমাত্মিক গুণাবলীর সমাবেশ হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, ঘৃণা, পরনিন্দা ও পরশ্রীকাতরতার মত এমন জঘন্যতম পাপ থেকে মুক্তি লাভ এবং তাকে আধ্যাত্মিক শক্তিতে শক্তিমান করার জন্যই সিয়াম সাধনার নির্দেশনা। 



রোযা মানুষকে ফেরেশতাদের অনুকরণের মাধ্যমে যতদূর সম্ভব নিজেকে প্রবৃত্তির গোলামি থেকে মুক্ত হওয়ার শিক্ষা দেয়। কেননা, ফেরেশতারা সকল পার্থিব চাহিদা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং  মানুষের মর্যাদাও হচ্ছে পশুত্বের বহু ঊর্ধ্বে জৈবিক চাহিদাকে মোকাবিলা করার জন্য তাকে দেয়া হয়েছে বিবেক-বুদ্ধির আলো, তাই সে এই বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে হতে পারে ফেরেশতাদের চেয়েও বহুগুণে উন্নত।



রোযা মানুষকে তার পাশবিক ইচ্ছা ও জৈবিক অভ্যাস থেকে মুক্ত করে এবং জৈবিক চাহিদাসমূহের মাঝে সুস্থতা ও স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠা করে। রোযার বিধান পালনের মাধ্যমেই মানুষ আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন করে। পশুত্ব নিস্তেজ হয়ে যায়। মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয় এবং দারিদ্র্য পীড়িত অগণিত আদম সন্তানের অনাহার ক্লিষ্ট মুখ তখন তার অন্ততরে (ধনীর অন্ততরে) সহানুভূতির উদ্রেক করে, অন্তর বিগলিত হয় মহান আল্লাহ পাকের কৃতজ্ঞতায়। 



রোযা মানুষের সকল অঙ্গ -প্রত্যঙ্গকে হেফাজত করে দুনিয়া ও আখেরাত বিনষ্টকারী কাজ থেকে, বস্তুতঃ রেযা হচ্ছে মুত্তাকীদের জন্য লাগামস্বরূপ। রোযা এমন এক মজবুত ঢাল, যা মানুষকে শয়তানের সকল আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষায় সাহায্য করে। রোযা মানুষের অন্তরে স্থির প্রশান্তি আনয়নের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহ কেন্দ্রিক করে তোলে। দৈহিক সুস্থতার জন্য রোযা যেমন উপকারী, তদ্রূপ পবিত্র জীবন যাপনের পক্ষেও তা খুবই সহায়ক। 



রোযা এবাদতের অনুভূতি জাগ্রত করে। এবাদত  বন্দেগী করার অনুভূতি জাগ্রত করার পাশাপাশি যে জিনিসটি অনিবার্য ফল হিসেবে স্বতঃই মানব মনে সৃষ্টি হয়, তাহলো মানুষ নিজেকে যার বান্দা মনে করে, তাঁর হুকুমেরও আনুগত্য করা। প্রকৃতপক্ষে আনুগত্য হলো নিরংকুশ প্রভুত্বের স্বীকৃতিরই ফসল, যখন মানুষের মাঝে আল্লাহর এবাদত করার অনুভূতি জাগ্রত হয়, তখনই সে আল্লাহর সকল নির্দেশ মেনে চলতে শুরু করে। 



রোযার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো চরিত্র গঠন। প্রকৃতপক্ষে তাকওয়াই ইসলামী চরিত্রের জীবনীশক্তি। ইসলাম প্রতিটি মুসলমানের মধ্যে যে ধরনের চরিত্র সৃষ্টি করতে চায়, তার ইসলামী ধারণা এই "তাকওয়া" শব্দটির মধ্যেই নিহিত। রোযাদার রোযার সমগ্র শর্তাবলী পূর্ণ করে যেসব গুণ বা বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে সক্ষম হয় তা মানুষের চরিত্র গঠনের অনন্য উপায়।



রোযা মানব জীবনের বিশ্রাম নেয়ার প্রবণতা ও যৌন চাহিদা এবং  উদর চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করে, আত্মসংযমের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। রোযা অবস্থায় রোজাদার কোন কিছু খেতে বা পান করতে পারে না। স্ত্রী সহবাস করতে পারে না। অপর দিকে রাতে তারাবীহ নামায ও সাহরী খাওয়ার জন্য লাগামহীনভাবে বিশ্রামও নিতে পারে না। যার ফলে মানুষের মধ্যে যে জৈবিক ও পাশবিক চরিত্র-বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা নিঃশেষ হয়ে আত্মসংযমের মতো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য জন্ম লাভ করে। 



মানুষের সামাজিক জীবনকে সুশৃঙ্খল ও সুসংবদ্ধ করার ব্যাপারে রোযার ভুমিকা অবিস্মরণীয়। সামাজিকতার ভিত্তিতেই মানুষ তার তাকওয়াকে সঠিক মানে পৌঁছাতে সফল হয়ে থাকে। যেহেতু সকলে এক সাথে একই উদ্দেশ্যে রোযা রাখছে, তাই এতে সত্যিই এক সামাজিক প্রভাব পড়ে, যা সম্পূর্ণ পরিবেশকে আল্লাহর ভয়ের প্রতি আহবান জানায়। ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় তাকওয়ার এক পবিত্র পরিবেশ। তখন মানুষ ভাল কাজ করতে উদ্যোগী হয় এবং খারাপ কাজ করতে লজ্জা অনুভব করে, প্রতিটি লোক গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য নিজেই চেষ্টা করে। নেকের প্রতি আগ্রহ এবং অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়। তওবা, ভয় ও খোদাপ্রীতির প্রতি স্বাভাবিক ঝোঁক, প্রবণতা সৃষ্টি হয়। 



রোযা মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করে। সমস্ত মানুষ মিলে এক আল্লাহর সন্তুষ্টি চাওয়া, তাঁরই সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ক্ষুৎ-পিপাসার কষ্ট সহ্য করা, তাঁরই ভয়ে সমস্ত অন্যায় পরিত্যাগ করা এবং একে অপরকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখা, তাঁরই মহব্বতে কল্যাণের দিকে দৌড়ে যাওয়া এমন জিনিস যা তাদের মধ্যে উত্তমমানের একত্ব, বিশুদ্ধ জাতীয়তাবোধ, পবিত্রতম ও সম্মিলিত মানসিকতা এবং এমন সহানুভূতি ও বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে যা সর্ববিধ কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত।



সব শেষে বলা যায় যে, আল্লাহ তা'আলার এই বিধান রোযার মাধ্যমে ইসলাম তার অনুসারীদেরকে ব্যক্তিগতভাবে একটি বিশেষ ধরনের নৈতিক শিক্ষা দিয়ে তৈরী করে সামাজিক জীবনে তাকওয়ার অনুভূতি সৃষ্টির প্রেরণা যুগিয়ে থাকে। সাথে সাথে তাদেরকে একত্রিত করে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে আল্লাহ তা'আলার সন্তোষ অর্জনে সক্ষম করে তোলে। 


লেখকঃ খতীব, আব্দুচ্ছালাম বাগেরহাটী, পিলখানা, ঢাকা। 




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন