হাবিল ও কাবিলের কাহিনী বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- "আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের বাস্তব অবস্থা পাঠ করে শুনান। যখন তারা উভয়েই কিছু উৎসর্গ নিবেদন করেছিল, তখন তাদের একজনের উৎসর্গ গৃহীত হয়েছিল এবং অপরজনের গৃহীত হয়নি। সে বললঃ আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। সে বললঃ আল্লাহ্ ধর্মভীরুদের পক্ষ থেকেই তো গ্রহণ করেন।- (সূরা আল-মায়িদাহ-০৫ঃ২৭)।
এআয়াতে তাদেরকে পুত্রদ্বয়ের কাহিনী বিশুদ্ধ ও বাস্তব ঘটনা অনুযায়ী শুনিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছে। কেননা, ঐতিহাসিক ঘটনাবলী বর্ণনায় খুবই সাবধানতা প্রয়োজন এবং এতে কোনরূপ মিথ্যা জালিয়াতি ও প্রতারণার মিশ্রণ না থাকা চাই এবং প্রকৃত ঘটনা পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত না হওয়া চাই। -(ইবনে কাসীর)। মহানবী (সাঃ) বাহ্যতঃ নিরক্ষর হওয়া সত্বেও হাজারো বছর পূর্বেকার ঘটনাবলী যেভাবে বিশুদ্ধ ও সত্য সত্য বর্ণনা করেছেন, তার কারণ খোদায়ী ওহী ও নবুওয়ত ছাড়া আর কি হতে পারে?
ঘটনাটি এইঃ যখন আদম ও হাওয়া (আঃ) পৃথিবীতে আগমন করেন এবং সন্তান প্রজনন ও বংশ বিস্তার আরম্ভ হয়, তখন প্রতি গর্ভ থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা-এরূপ যমজ সন্তান জন্মগ্রহণ করত। তখন ভ্রাতা-ভগিনী ছাড়া হযরত আদমের আর কোন সন্তান ছিল না। অথচ ভ্রাতা-ভগিনী পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। তাই আল্লাহ তা'আলা উপস্থিত প্রয়োজনের খাতিরে আদম (আঃ)- এর শরীয়তে বিশেষভাবে এ নির্দেশ জারি করেন যে, একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করবে, তারা পরস্পর সহোদর ভ্রাতা-ভগিনী গন্য হবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হবে।
কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী পুত্রের জন্যে প্রথম গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারিনী কন্যা সহোদরা ভগিনী গণ্য হবে না। তাদের পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ হবে। কিন্তু ঘটনাচক্রে কাবিলের সহজাত সহোদরা ভগিনীটি একলিমা ছিল পরমাসুন্দরী এবং হাবিলের সহজাত কন্যাটি লুবাদা ছিল কুশ্রী ও কদাকার। বিবাহের সময় হলে নিয়মানুযায়ী হাবিলের সহজাত কুশ্রী কন্যা কাবিলের ভাগে পড়ল। এতে কাবিল অসন্তুষ্ট হয়ে হাবিলের শত্রু হয়ে গেল। সে জেদ ধরল যে, আমার সহজাত ভগিনীকেই আমার সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে।
হযরত আদম (আঃ) তাঁর শরীয়তের আইনের পরিপ্রেক্ষিতে কাবিলের আব্দার প্রত্যাখ্যান করলেন। আল্লাহ তা'আলার নির্দেশমত আদম (আঃ) হাবিলের সাথে কাবিলের জমজ বোন একলিমার বিয়ের পক্ষে থাকলেও কাবিলের দাবি অনুযায়ী বিষয় সূরাহা করার জন্য হাবিল ও কাবিলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশে তিনি বললেনঃ তোমরা উভয়েই আল্লাহ তা'আলার জন্যে নিজ নিজ কুরবানী পেশ কর। যার কুরবানী পরিগৃহীত হবে, সেই কন্যার পানি গ্রহণ করবে। হযরত আদম (আঃ) -এর নিশ্চিত বিশ্বাস যে, যে সত্য পথে আছে, তার কুরবানীই গৃহীত হবে।
তৎকালে কুরবানী গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল এই যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে কুরবানীকে ভস্মীভূত করে আবার অন্তর্হিত হয়ে যেত। যে কুরবানী অগ্নি ভস্মীভূত করত না, তাকে প্রত্যাখ্যাত মনে করা হত।
হাবিল ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি পশু পালন করত। সে একটি উৎকৃষ্ট দুম্বা কুরবানী করল। কাবিল কৃষিজাত করত। সে কিছু শস্য, গম ইত্যাদি কুরবানীর জন্যে পেশ করল। অতঃপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা অবতরণ করে হাবিলের কুরবানীটি ভস্মীভূত করে দিল এবং কাবিলের কুরবানী যেমন ছিল, তেমনি পড়ে রইল। এ অকৃতকার্যতায় কাবিলের দুঃখ ও ক্ষোভ বেড়ে গেল। সে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রকাশ্যে ভাইকে বলে দিলঃ অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব।
হাবিল তখন ক্রোধের জওয়াবে ক্রোধ প্রদর্শন না করে একটি মার্জিত ও নীতিগত বাক্য উচ্চারণ করল। এতে কাবিলের প্রতি তার সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা ফুটে উঠেছিল। সে বললঃ আল্লাহ তা'আলার নিয়ম এই যে, তিনি খেদাভীরু পরহেজগারের কর্মই গ্রহণ করেন। তুমি খোদাভীতি অবলম্বন করলে তোমার কুরবানীও গৃহীত হত। তুমি তা করনি, তাইে তোমার কুরবানী প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এতে আমার দোষ কি?
হাবিল বললঃ "যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবে আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার দিকে হস্ত প্রসারিত করব না। কেননা, আমি বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লহকে ভয় করি। -(সূরা মায়েদাহ-০৫ঃ২৮)। আমি চাই যে, আমার পাপ ও তোমার পাপ তুমি নিজের মাথায় চাপিয়ে নাও। অতঃপর তুমি দোযখীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। এটা অত্যাচারীদের শাস্তি।"-(সূরা মায়েদাহ-০৫ঃ২৯)।
অতঃপর তার (কাবিলের) অন্তর তাকে ভ্রাতৃহত্যায় উদ্বুদ্ধ করল। অনন্তর সে (কাবিল) তাকে (হাবিলকে) হত্যা করল। ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। -(সূরা মায়েদাহ-০৫ঃ৩০)। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা (সেখানে) একটি কাক পাঠালেন, কাকটি (হত্যাকারীর সামনে এসে) মাটি খুঁড়তে লাগলো, উদ্দেশ্য, তাকে দেখানো কিভাবে সে তার ভাইয়ের লাশ লুকিয়ে রাখবে; (এটা দেখে) সে (নিজে নিজে) বলতে লাগলো, হায়! আমি তো এই কাকটির চাইতেও অক্ষম হয়ে পড়েছি, আমি তো আমার ভাইয়ের লাশটাও গোপন করতে পারলাম না, অতঃপর সে সত্যি সত্যিই ( নিজের কৃতকর্মের জন্যে) অনুতপ্ত হলো। -(সূরা মায়েদাহ-০৫-৩১)।
লেখকঃ খতীব আব্দুচ্ছালাম বাগেরহাটী, পিলখানা, ঢাকা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন