হাদীস ও সুন্নাহ অস্বীকার করার ফেতনা ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম দ্বিতীয় হিজরী শতকে উত্থিত হয়েছিল। এই ফিতনার সূত্রপাত করেছিল খারেজী ও মুতাযিলা সম্প্রদায়। তারা মুসলিম সমাজে যে নৈরাজ্য ছড়াতে চাচ্ছিল তার পথে রসূলুল্লাহ (সাঃ)- এর হাদীস ও সুন্নাহ প্রতিবন্ধক ছিল যা এই সমাজকে একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্হার উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এজন্যই তারা হাদীসকে সন্দেহযুক্ত মনে করে এবং সুন্নাহকে দলীল হিসেবে গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়।
মুহাদ্দিসগণ বলেন- রসূলুল্লাহ (সাঃ) - এর হাদীস ও সুন্নাহ যেসব রিওয়ায়াতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় তা কখনও সন্দেহযুক্ত নয়, বরং অতীব বিশ্বস্ত মাধ্যমে উম্মাতের নিকট পৌঁছেছে। হাদীস ও সুন্নাহ পবিত্র কুরআনেরই ব্যাখ্যা। কেননা ইসলামী জীবন ব্যাবস্হায় মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শুধু কুরআন মাজীদ পৌঁছে দেয়ার জন্য তাঁকে একজন পত্রবাহক মাত্র নিযুক্ত করা হয়নি, বরং আল্লাহ তা'আলা তাঁকে শিক্ষক, পথপ্রদর্শক, কুরআনের ভাষ্যকার, আইনপ্রণেতা এবং বিচারক ও প্রশাসকও নিযুক্ত করেছিলেন। অতএব স্বয়ং কুরআন মাজীদের আলোকেই তাঁর আনুগত্য ও অনুবর্তন আমাদের জন্য ফরয এবং তা থেকে মুক্ত হয়ে যে ব্যক্তি কুরআনের অনুসরণের দাবী করে সে মূলতঃ কুরআনের অনুসারীই নয়।
মহানবী (সাঃ) - এর নবূওয়াতী জীবনের সমস্ত কাজ যা তিনি তেইশ বছরে আঞ্জাম দিয়েছেন, কুরআন মাজীদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং এই সুন্নাত কুরআনের সাথে মিলিত হয়ে আল্লাহ তা'আলার মহান বিধানের গঠন ও পূর্ণতা প্রদান করে এবং এই সমগ্র কাজ মহানবী (সাঃ) যেহেতু নবী হিসেবে করেছেন, তাই তিনি এসব কাজে কুরআন মাজীদের মতই আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছা ও মর্জির প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
মহানবী (সাঃ) রসূল হিসেবে যেসব কথা বলেছেন এবং যেসব কাজ করেছেন তা সবই সুন্নাত এবং তার অনুসরণ উম্মতের জন্য বাধ্যতামূলক। সুন্নাত যদি কুরআনের অতিরিক্ত কোন জিনিস না বলে তাহলে যা কুরআনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখিত হয়নি। যেমন কুরআন মাজীদ "নামায কায়েমের" নির্দেশ দিয়েই থেমে যায়। তা সুন্নাতই বলে দেয় যে, নামাযের অর্থ কি এবং তা কায়েম অর্থই বা কি। এউদ্দেশ্যে সুন্নাতই মসজিদ নির্মাণ, পাঁচ ওয়াক্ত আযান ও জামাআতের সাথে নামায আদায়ের পন্থা, নামাযের ওয়াক্তসমূহ, নামাযের ধরন, তার রাকআত সংখ্যা, জুমুআ ও দুই ঈদের বিশেষ নামায এবং তার বাস্তব রূপ এবং আরও বিভিন্ন দিক বিস্তারিতভাবে আমাদের বলে দেয়।
মহানবী (সাঃ) ছিলেন আল্লাহ তা'আলার কিতাব পবিত্র কুরআনের ভাষ্যকার। সূরা নাহল-এর ৪৪ নং আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেনঃ "এবং (হে নবী!) এই যিকির তোমার উপর নাযিল করেছি, যেন তুমি লোকদের সামনে সেই শিক্ষাধারার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে থাক, যা তাদের উদ্দেশ্যে নাযিল করা হয়েছে " -(সূরা নাহল-১৬ঃ৪৪)। কোন কিতাবের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুধুমাত্র সেই কিতাবের মূল পাঠ পড়ে শুনিয়ে দিলেই হয়ে যায় না, বরং ব্যাখ্যা দানকারী তার মূল পাঠের অধিক কিছু বলে থাকেন, যাতে শ্রবণকারী কিতাবের অর্থ পূর্ণরূপে বুঝতে পারে।
কুরআন পাকে আল্লাহ তা'আলা হুকুম করেছেন যে, তোমরা যখন নামাযের জন্য উঠো, তখন নিজেদের মুখ এবং কনুই পর্যন্ত উভয় হাত ধৌত কর, মাথা মাসেহ কর এবং পদদ্বয় ধোত কর বা তা মাসেহ কর। -(সূরা মায়েদা-০৫ঃ০৬)। মহানবী (সাঃ) বলে দেন যে, মুখ ধৌত করার নির্দেশের মধ্যে কুলকুচি করা ও নাক পরিষ্কার করাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কান মাথার একটি অংশ, তাই মাথার সাথে কানও মাসেহ করতে হবে। পদদ্বয়ে মোজা পরিহিত থাকলে তা মাসেহ করবে এবং মোজা পরিহিত না থাকলে তা ধৌত করবে। সাথে সাথে তিনি এটাও সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন যে, কোন্ অবস্থায় উযু ছুটে যায় এবং কোন্ অবস্থায় তা অবশিষ্ট থাকে।
কুরআন মাজীদে হজ্জ ফরজ হওয়ার সম্পর্কে সাধারণ নির্দেশ প্রদান করেছে এবং পরিষ্কারভাবে বলেনি যে, এই ফরজ কার্যকর করার জন্য প্রত্যেক মুসলমানকে প্রতি বছর হজ্জ করতে হবে, নাকি জীবনে একবার হজ্জ করাই যথেষ্ট, অথবা একাধিকবার হজ্জে যাওয়া উচিত (দ্র. আল-ইমরান-০৩ঃ৯৭)? এটা আমরা মহানবী (সাঃ)-এর ব্যাখ্যার মাধ্যমেই জানতে পারি যে, জীবনে একবার মাত্র হজ্জ করেই কোন ব্যক্তি হজ্জের ফরজিয়াত থেকে অব্যাহতি পেতে পারে।
মহানবী (সাঃ) "আল্লাহ তা'আলা যা নাযিল করেছেন" তদনুযায়ী কাজ করতেন, কিন্তু তাঁর উপর শুধু সেই ওহীই নাযিল হত না যা কুরআনে পাওয়া যায়, বরং এ ছাড়াও তিনি ওহীর মাধ্যমে নির্দেশ প্রাপ্ত হতেন। তাই মহানবী (সাঃ) শুধুমাত্র কুরআন মাজীদ পৌঁছে দেয়ার সীমা পর্যন্ত নবী ছিলেন না। উম্মতকে কেবলমাত্র কুরআন মাজীদ অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয় নেই। বরং রসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ "হে নবী! বলে দাও যে, তোমরা যদি আল্লাহ তা'আলার প্রতি ভালোবাসা পোষণ কর তবে আমার অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তা'আলা তোমাদের ভালোবাসবেন।"-(সূরা আল ইমরান-০৩ঃ৩১)।
রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ব্যক্তিসত্তাও নবূওয়াতী সত্তা। মহানবী (সাঃ) শরীআতের বিধান হিসেবে যা বলেছেন তার অনুসরণ বাধ্যতামূলক। মহানবী (সাঃ)- এর নবূওয়াতী জীবনের সমস্ত কাজ যা তিনি তেইশ বছরে আঞ্জাম দিয়েছেন, কুরআন মাজীদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অতএব স্বয়ং কুরআন মাজীদের আলোকেই মহানবী (সাঃ)- এর আনুগত্য ও অনুবর্তন আমাদের জন্য ফরজ এবং তা থেকে মুক্ত হয়ে যে ব্যক্তি কুরআনের অনুসরণের দাবী করে সে মূলত কুরআনের অনুসারীই নয়।
লেখকঃ খতীব আব্দুচ্ছালাম বাগেরহাটী, পিলখানা, ঢাকা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন