ইসলামে শ্রমের মর্যাদা। খতীব আব্দুচ্ছালাম বাগেরহাটী, পিলখানা, ঢাকা।

মহানবী (সাঃ) শুধু ইবাদত বা আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে পরিশ্রমী ছিলেন না, তিনি কায়িক পরিশ্রমীও ছিলেন। তিনি ইহুদির ক্ষেতে পানি তুলেছেন এবং মজুরী হিসেবে প্রতি পাত্র পানির জন্য একটি খেজুর নিয়েছেন। তাঁর আদর্শের অনুসারী হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত উমর (রাঃ), হযরত উছমান (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ)-ও কঠোর পরিশ্রমী  ছিলেন। কায়িক পরিশ্রমকে ঘৃণা করা আর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ও তাঁর প্রিয় সাহাবীদের ঘৃণা করা সমান।


শারীরিক পরিশ্রম না করলে শারীরিক শক্তি অর্জিত হয় না। কঠোর কায়িক পরিশ্রম করতেন বলেই রসূল (সাঃ) অমিত শারীরিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি একবার কুস্তি লড়ে আরবের শ্রেষ্ঠ পাহলোয়ান রাকানাকে  পরাজিত করেছিলেন। শ্রমের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন আমাদের প্রিয়নবী (সাঃ)। তিনি বলেছেনঃ " নিজের দুই হাতের উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কেউ কোনো দিন খায়নি" (বুখারী)।


গতর খেটে উপার্জন করা ইসলামের দৃষ্টিতে কোন লজ্জাজনক কাজ নয়। হালাল রুজি তালাশ করা তা যেভাবেই হোক অত্যন্ত প্রশংসনীয় কাজ; দ্বিতীয় স্তরের ফরজ। রাসূল (সাঃ) বলেনঃ " হালাল জীবিকা সন্ধান করা ফরযের পর একটি ফরয" ( বায়হাকী, সূত্রঃ মিশকাত)। পরিশ্রম না করে অলস বেকার ও কর্মবিমুখ ঘরে বসে থাকা ইসলামে হারাম। হাদীস শরীফে দেখা যায়, নবীগণ পরিশ্রম করে উপার্জন করতেন। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছেঃ " সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ  (রিযিক) সন্ধান করো" (সূরা জুমুআ-৬২ঃ১০)।


মহানবী (সাঃ) যখনই শ্রমিক মালিকের সম্পর্কের কথা আলোচনা করতেন, তখনই একান্ত আবেগের সঙ্গে বলতেন, ' যারা তোমাদের কাজ করছে তারা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ এদেরকে তোমাদের অধীনস্ত করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তোমাদের অধীনস্তদের সাথে ভাল ব্যবহার কর।- (বুখারী)। অন্য হাদীসে উল্লেখ রয়েছে  হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- ' তোমরা শ্রমিকের পারিশ্রমিক তার শরীরের ঘাম শুকানোর পুর্বেই দিয়ে দাও।'


ইসলামের দৃষ্টিতে একজন শ্রমিক মালিকের কাজের দায়িত্ব নিজের পছন্দনুযায়ী আপন কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে এমন এক নৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে যায়, যা শুধু পেট চালাবার নিমিত্তেই সে করবে না, করবে আখেরাতের সফলতার জন্য। হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ' যার মধ্যে আমানতদারী নেই তার মধ্যে ঈমানও নেই।' মালিকের যে কাজ তার ওপর ন্যস্ত আছে, সেই এর সংরক্ষণ করবে, হেফাজত করবে।


ইসলামের মূল কথা হলো হযরত নবী করীম (সাঃ) বলেন, ' নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ো না এবং অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত  করো না।' অন্য হাদীসে হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ' তোমরা মানুষকে অত্যাচার এবং শোষণ করো না। নিশ্চয়ই যারা দুনিয়ার মানুষের ওপর শোষণ চালাবে, তাকে কেয়ামতের দিন মারাত্মক শাস্তি প্রদান করা হবে।' -(বুখারী)।


মালিক শ্রমিককে দিয়ে কি ধরনের কাজ নিতে চায় তাও পূর্বেই নির্ধারণ করে নিতে হবে। মজুরের সম্মতি ব্যতিরেকে তাকে যে কোন কাজে নিয়োগ করার স্বাধীনতা ইসলাম পুঁজিপতিকে দেয়নি।

রাসূল (সা.) বলেছেন, “তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তায়ালা যে ভাইকে তোমার অধীন করে দিয়েছেন তাকে তা-ই খেতে দাও, যা তুমি নিজে খাও, তাকে তা-ই পরিধান করতে দাও, যা তুমি নিজে পরিধান কর।” (বুখারী, আবু হুরায়রা রাযি.)।

হযরত আবুবকর (রাযি.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, “ক্ষমতার বলে অধীন চাকর-চাকরানী বা দাস-দাসীর প্রতি মন্দ আচরণকারী বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (ইবনে মাজাহ)।

তিনি আরো বলেন, “কেউ তার অধীন ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে এক দোররা মারলেও কেয়ামতের দিন তার থেকে এর বদলা নেয়া হবে।”

ইসলাম শ্রমিকদের অধীকারের প্রতি সম্মান প্রর্দশন করে। শ্রমিককে কষ্ট দেয়া জাহেলিয়াতের যুগের মানসিকতা মনে করে। এ ব্যাপারে হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন আমার দাস, আমার দাসী, না বলে। কেননা আমরা সবাই আল্লাহর দাস-দাসী”। ওমর ইবনে হুরাইস (রাযি.) হতে বর্ণিত নবী করিম (সা.) বলেছেন, “তোমরা তোমাদের কর্মচারীদের থেকে যতটা হালকা কাজ নিবে তোমাদের আমলনামায় ততটা পুরস্কার ও নেকী লেখা হবে।


শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে তিল তিল করে গড়ে উঠে শিল্প প্রতিষ্ঠান। একটি শিল্পের মালিক শ্রমিকদের শ্রম শোষণ করে অল্প সময়েই পাহাড় পরিমাণ অর্থ-বিত্তের মালিক হয়। শ্রমিকদের কম মজুরি দিয়ে, তাদের ঠকিয়ে গড়ে তোলে একাধিক শিল্প-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কারখানায় তাদের কোনো অংশিদারিত্ব থাকে না। এ ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন, “মজুরকে তার কাজ হতে অংশ দান কর, কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যায় না।” (মুসনাদে আহমাদ)।


ইসলামই শ্রমিকের জীবনের ও তার শ্রমের পরিপূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করেছে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে কথাগুলো বুঝার এবং আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন