কুর'আন সম্মত মুসলিম জীবন

একমাত্র ইসলামের মধ্যেই রয়েছে পরিপূর্ণ জীবন বিধান। ইসলাম এবং ঈমান হলো মুসলিম জীবনের দৃশ্যমান কার্যক্রম আর ইহসান হলো তাদের আধ্যাত্মিক লক্ষ্যবস্তু। মুসলমানকে একমাত্র আল্লাহ তা'আলারই এবাদত করতে বলা হয়েছে, তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। আদম (আঃ) থেকে মহানবী (সাঃ) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূল এই একই কথা স্মরণ করিয়ে দিতে এসেছিলেন। 



মানুষকে আল্লাহ তা'আলা তাঁর খলীফা বা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন, আর সে যেন তার দায়িত্ব নির্ভুলভাবে পালন করতে পারে, তাই তাকে ইচ্ছা করার স্বাধীনতাও দিয়েছেন। আর তিনি কি পছন্দ করেন আর কি অপছন্দ করেন, সেই জ্ঞানও তাকে দিয়েছেন। মানুষ যে কাজের ইচ্ছা করেছে, সেটা যদি আল্লাহ তা'আলারও ইচ্ছা হয়ে থাকে, অর্থাৎ সেই কাজের পেছনে যদি আল্লাহ তা'আলার অনুমোদন থাকে, তাহলে সে পুরস্কৃত হয়, অন্যথায় সে শাস্তি পায়।



আগেই বলা হয়েছে,  ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধানের নাম। এর গোটা শিক্ষার সুসমন্বিত প্রয়োগই মানুষের জীবনকে সফল করতে পারে। ইসলামে মানবজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত আক্বীদা ও আমল পূর্ণতা পেয়েছে। জীবনের সবকিছুর বর্ণনা দিয়েছে একমাত্র ইসলাম, এখানে কোনকিছুই ব্যক্তিগত পছন্দ ও ধারণার উপর ছেড়ে দেয়া হয়নি। তাই মুসলমানের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন আবর্তিত হয় কুর'আন ও হাদীসের আলোকে। 



মানুষ স্বাভাবিকভাবেই অনেক কিছু বোঝে, সে অনেক মেধাবান, কিন্তু তার এই গুণগুলিকে জাগিয়ে তোলার জন্য একজন শিক্ষকের প্রয়োজন। আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ প্রত্যেক উম্মতের জন্য এক একজন রসূল রয়েছে। -লিকুল্লি উম্মাতির রাসূল।- (সূরা ইউনুস -১০ঃ৪৭)। আর নবী-রাসূলগণ ছিলেন শিক্ষক। এটাই মানুষের জন্য স্বাভাবিক এবং এটাই চিরকাল ঘটেছে। 


মানুষকে একমাত্র সেই ব্যক্তি নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন যিনি প্রত্যয়ের সাথে বলেছেন যে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পাঠিয়েছেন, যেমন- আমি নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য একজন বিশ্বস্ত রসূল, অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয়-ভক্তি কর ও আমাকে মেনে চল। (ইন্নি লাকুম রসূলুন আমীন, ফাত্তাক্বুল্লাহা ওয়া আতী'উন)। অতএব , নবীদের দেয়া মূল্যবোধের ভিত্তিতে মানুষ তার সামাজিক আইন গড়ে তোলে, আর তাদেরই অনুমোদিত বিশ্বাসের ভিত্তিতে সে সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক স্হাপন করে। 



আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, তুমি যদি আমাকে মেনে নিয়ে থাকো, তাহলে আমার সামনে মাথা নত করো। যেমনঃ ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা রুকু করো ও সিজদা করো, আর তোমাদের প্রভুর এবাদত করো এবং ভাল কাজ করো যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। -(সূরা হজ্জ-২২ঃ৭৭)। কুর'আন আমাদেরকে সারাক্ষণ আল্লাহ তা'আলার সামনে নত হবার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নত হওয়া নতি স্বীকার করার প্রতীক। 



এবাদতের এই কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা এবিষয়ে সদা জাগ্রত থাকি যে আল্লাহ তা'আলারই এককভাবে আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁরই কাছে আমরা দায়বদ্ধ। আমরা তাঁর সার্বভৌমত্ব ক্ষমতার অধীনে রয়েছি। তিনি আমাদেরকে অনেক অধিকার দিয়েছেন, কিন্তু পরম ক্ষমতার অধিকারী স্বয়ং তিনি। এবাদতের মাধ্যমে এটা আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে; বারংবার তাঁর প্রতি আনুগত্য নবায়ন করতে হবে। 



অনেকে মনে করে, আমরা এবাদতের অনুষ্ঠানগুলি হিসাবমত পালন করছি, অতএব আল্লাহ তা'আলা আমাদের উপর নিশ্চয় সন্তুষ্ট, আর এটাই যথেষ্ঠ। এরপর আমরা যা কিছু করি, সেগুলি জীবনের স্বাভাবিক অংশ। বেঁচে থাকার তাগিদে এগুলি না করলে চলে না; এতে দোষের কিছু নেই - যেমন চুরি, মিথ্যা, সম্পত্তি দখল ইত্যাদি। আসলে এধরনের চিন্তা আত্মপ্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা ধর্মের বিকৃতি। নৈতিক শুদ্ধতা আর ভক্তিপূর্ণ এবাদত, এই দু'টি আল্লাহ তা'আলারই নির্দেশ। এবাদতের অনুষ্ঠান হোক আর নৈতিক মূল্যবোধ হোক, দুই ক্ষেত্রেই আমাদের অনেক সংশোধন প্রয়োজন রয়েছে। 


মানুষ যখনই মনে করে যে একটা বড় শক্তি তাকে নজরে রেখেছে, তখনই সে অশ্লীল ও অশুভ কাজ থেকে বিরত থাকে। ধর্মকে একবার বাদ দিলে, আর নিজের খেয়াল -খুশী মতো কাজ করলে, ব্যক্তি এবং সমষ্টির জীবনে নৈরাজ্য আসতে বাধ্য। কুর'আনে একথাই স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব আমাদেরকে বদলাতে হবে। ঘুরে দাঁড়াতে হবে। কুর'আনের কাছে ফেরত যেতে হবে। 



ইসলাম ধর্মকে মেনে নেয়ার পর মুসলমানের প্রথম কাজ হলো মনোভাবের পরিবর্তন। মুসলমান সত্যিকার অর্থে তখনই ইসলাম পালন করে যখন তার বাহ্যিক পরিবর্তন আর ভেতরের পরিবর্তন একজায়গায় মিলিত হয়। ইসলামি মনোভাবের প্রথম ভিত্তি হলো তৌহীদ। দ্বিতীয় ভিত্তি হলো রিসালাত। একজন মুসলমানের মনের বা অন্তরে যে বিশ্বাসগুলি তার চালিকাশক্তি হিসেবে স্হান ক'রে নিয়েছে, সেগুলিকেই ঈমান বলা হয়। আর যেসকল অভীষ্ট কাজের ভেতর দিয়ে সেই বিশ্বাসগুলির বহিঃপ্রকাশ ঘটে, সেগুলির সমষ্টির নামই ইসলাম। 



মুসলমানের সকল কাজের মধ্যে আল্লাহ তা'আলার হুকুম পালনের একটা সচেতন নিয়ৎ বা অভিপ্রায় থাকে। এভাবেই সে আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য অর্জন করে। তার সব কাজ আল্লাহ তা'আলার জন্য, নিজের জন্য নয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার কাজে নিয়োজিত থাকে, আল্লাহ তা'আলা তাকে তার ব্যক্তিগত চিন্তা থেকে মুক্ত ক'রে দেন। মান কানা লিল্লাহি কানাল্লহু লাহু। 



 কুর'আনের সর্বত্র ঈমান ও সৎকর্মের কথা একযোগে বলা হয়েছে। সৎকর্মের দু'টি মূল ধারা।একটি হলো এবাদত। আর অপরটি হলো আল্লাহ তা'আলার সকল অনুদানকে মানুষের উপকারের জন্য ব্যয় করা। এবাদত, যা অন্তরের পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিক শক্তি বাড়ায়, তার মধ্যে অন্যতম কাজ হলো নামায, রোযা, হজ্জ, যিকির, ইত্যাদি। সম্পদ থেকে ব্যয় করা, যা বাহ্যিক পবিত্রতা ও নৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করে, তার মধ্যে রয়েছে যাকাত, ফেতরা ও নানাবিধ জনকল্যাণ মূলক কাজ। 



আল্লাহ তা'আলার হুকুম পালন বেতনভোগী কর্মচারীর হুকুম পালনের মতো নয়, যার মধ্যে কর্মকর্তার সাথে কোন ভালোবাসা বা মনের সম্পর্ক থাকে না, থাকে শুধু বেতন বা অন্য কোন লেনদেনের চুক্তি। অবশ্যই মানুষ সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ হতে পারে না। তবুও, ভালবাসা তাকে বহুল অংশে স্বার্থহীন হতে সাহায্য করে, এবং সিদ্ধি অর্জনের পথ খুলে দেয়। অর্থাৎ, ভালবাসা হলো মুখ্য, আর দেনা-পাওনা হলো গৌণ। 



মানুষের আত্মার দু'টি দিক রয়েছে। একটির সম্পর্ক আল্লাহ তা'আলার সাথে, যা প্রকাশ পায় এবাদতের মাধ্য দিয়ে। অপরটির সম্পর্ক মনুষ্য -সমাজের সাথে। দুটিতেই রয়েছে ভালোবাসা - প্রথমটি অপ্রকাশ্য, দ্বিতীয়টি প্রকাশ্য। আল্লাহ তা'আলার সাথে আমাদের চূড়ান্ত সম্পর্কটা আত্মার সম্পর্ক। কুরআনে বলেছেনঃ তোমরা যেখানেই থাকে, তিনি তোমাদের সাথে আছেন। -ওয়াহুয়া মা'আকুম আইনামা কুনতুম।-(সূরা হাদীদ-৫৭ঃ০৪)।


লেখকঃ খতীব আব্দুচ্ছালাম বাগেরহাটী, পিলখানা, ঢাকা। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন