কুরআন মহানবী (সাঃ) -এর একটি সর্বশ্রেষ্ঠ গতিশীল দীর্ঘস্থায়ী মু'জেযা

অন্যান্য সমস্ত নবী ও রসূলগণের মু'জেযাসমূহ তাঁদের জীবন পর্যন্তই মু'জেযা ছিল। কিন্তু কুরআনের মু'জেযা মহানবী (সাঃ) -এর তিরোধানের পরও পূর্বের মতই মু'জেযা সুলভ বৈশিষ্ট্যসহই বিদ্যমান রয়েছে। আজ পর্যন্ত একজন সাধারণ মুসলমানও দুনিয়ার য়ে কোন জ্ঞানী-গুণীকে চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারে যে, কুরআনের সমতুল্য কোন আয়াত ইতিপূর্বেও কেউ তৈরী করতে পারেনি, এখনও কেউ পারবে না, আর যদি  সাহস থাকে তবে তৈরী করে দেখাও।



সুতরাং কুরআনের রচনাশৈলী, যার নমুনা আর কোনকালেই কোন জাতি পেশ করতে পারেনি, সেটাও একটি গতিশীল দীর্ঘস্থায়ী মু'জেযা। মহানবী (সাঃ)- এর যুগে যেমন এর নযীর পেশ করা যায়নি, অনুরূপভাবে আজও তা কেউ পেশ করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও সম্ভব হবে না। 



মুসলমানদের এ দাবী যে, চৌদ্দ শত বৎসরের এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কুরআনের এ চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও কেউ কুরআনের বা এর একটি সূরার অনুরূপ কোন রচনাও পেশ করতে পারেনি, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ দাবীর যথার্থতা কতটুকু এ দুটি বিষয়ই দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ। 



যে ভূ-খন্ডে এবং যে মহান ব্যক্তির প্রতি এ গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে, এর ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক অবস্থা জানতে গেলে সাক্ষাৎ ঘটবে এমন একটা ঊষর শুষ্ক মরুময় এলাকার সাথে যা ছিল বাতহা বা মক্কা নামে পরিচিত। কোন মক্তব -মাদ্রাসার মাধ্যমে এ ভাষাজ্ঞান অর্জন করার রীতি ছিল না। অধিবাসীদের মধ্যে এ ধরনের কোন আগ্রহও পরিলক্ষিত হতো না। যারা শহরে বাস করতো, তাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। পণ্যসামগ্রী একস্থান থেকে অন্যস্থানে আমদানি -রপ্তানীই ছিল তাদের একমাত্র পেশা।



সে দেশেই সর্বপ্রাচীন শহর মক্কার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে সে মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব, যাঁর প্রতি আল্লাহ তা'আলার পবিত্রতম কিতাব কুরআন নাযিল করা হয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তিনি পিতৃহীন হন, জন্মগ্রহণ করেন অসহায় এতীম হয়ে। মাত্র সাত বছর বয়সেই মাতৃবিয়োগ ঘটে। পিতৃ-মাতৃহীন অবস্থায় নিতান্ত কঠোর দারিদ্র্যের মাঝে লালিত -পালিত হন। যদি তখনকার মক্কায় লেখাপড়ার চর্চা থাকতো তবু্ও এ কঠোর দারিদ্র্যেপূর্ণ জীবনে লেখাপড়া করার কোন সুযোগ গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে কোন অবস্হাতেই সম্ভবপর হতো না। 



উম্মী হওয়া সত্বেও ভদ্রতা -নম্রতা, চরিত্রমাধুর্য ও অত্যন্ত প্রখর ধীশক্তি এবং সত্যবাদিতা ও আমানতদারীর অসাধারণ গুণ বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হতো, ফলে আরবের ক্ষমতাদর্পী বড়লোকগুলোও তাঁকেই শ্রদ্ধা ও সন্মানের চোখে দেখতো সমগ্র মক্কা নগরীতে তাঁকে আল-আমীন বলে অভিহিত করা হতো। 



এ নিরক্ষর ব্যক্তি চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত মক্কা নগরীতে এমনভাবে জীবনযাপন করেছেন যে, কোন পুস্তক বা লেখনী স্পর্শ করেছেন বলেও জানা যায় না, কোন মক্তবেও যাননি, কোন কবিতা বা ছড়াও রচনা করেননি। ঠিক চল্লিশ বছর বয়সে তাঁর মুখ থেকে সে বাণী নিঃসৃত হতে লাগল, যাকে কুরআন বলা হয়। 



যদি এ কালাম মানব ক্ষমতার উর্ধ্বে কোন অলৌকিক শক্তির রচনা না হতো, তবে অসাধারণ ভাষাজ্ঞান সম্পন্ন আরবদের পক্ষে এর মোকাবেলা কোন মতেই অসম্ভব হতো না, বরং এর চাইতেও উন্নত মানের কালাম তৈরী করা তাদের পক্ষে সহজ ছিল। দু'একজনের পক্ষে তা সম্ভব না হলে, কুরআন তাদেরকে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এমনটি রচনা করারও সুযোগ দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও সমগ্র আরববাসী একেবারে নিশ্চুপ রয়ে গেল কয়েকটি বাক্যও তৈরী করতে পারলো না! 



কুরআন কিছু গায়েবী সংবাদ এবং ভবিষ্যতে ঘটবে এমন অনেক ঘটনার সংবাদ দিয়েছে, যা হুবাহু সংঘটিত হয়েছে। এবং কুরআন শরীফে পূর্ববর্তী উম্মত, শরীয়ত ও তাদের ইতিহাস এমন পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সে যুগের ইহুদী -খৃষ্টানদের পন্ডিতগণ, যাদেরকে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের বিজ্ঞ লোক মনে করা হতো, তারাও এতটা অবগত ছিল না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলাই যে তাঁকে এ সংবাদ দিয়েছেন এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।



কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে মানুষের অন্তর্নিহিত বিষয়াদি সম্পর্কিত যেসব সংবাদ দেয়া হয়েছে পরে সংশ্লিষ্ট লোকদের স্বীকারোক্তিতে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ সব কথাই সত্য। একাজও আল্লাহ তা'আলারই কাজ, তা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। 



কুরআনের এমন সব আয়াত রয়েছে যাতে কোন সম্প্রদায় বা কোন ব্যক্তি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, তাদের দ্বারা অমুক কাজ হবে না; তারা তা করতে পারবে না। ইহুদীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, যদি তারা নিজেদেরকে আল্লাহর প্রিয় বান্দা বলেই মনে করে, তবে তারা নিশ্চয়ই তাঁর নিকট যেতে পছন্দ করবে। সুতরাং এমতাবস্থায় তাদের পক্ষে মৃত্যু কামনা করা অপছন্দনীয় হতে পারে না। আল্লাহ তা'আলা বলেন -"তারা কখনও তা চাইবে না"। মৃত্যু কামনার চ্যালেঞ্জে সাড়া দিলে সত্য -সত্যই তা ঘটবে। এজন্যই তারা কুরআনের এ প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সাহস পায়নি এবং একটি বারের জন্যও মুখ দিয়ে মৃত্যুর কথা বলেনি।



কুরআন শরীফ শ্রবণ করলে মু'মিন, কাফির, সাধারণ -অসাধারণ নির্বিশেষে সবার উপর দু’ধরনের প্রভাব সৃষ্টি হতে দেখা যায়। এবং কুরআনকে বারংবার পাঠ করলেও মনে বিরক্তি আসে না। বরং যতই বেশী পাঠ করা যায়, ততই তাতে আগ্রহ বাড়তে থাকে। অন্যের পাঠ শুনতেও আগ্রহ জন্মে। 



কুরআন ঘোষণা করেছে যে, কুরআনের সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ গ্রহণ করেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত এর মধ্যে বিন্দুবিসর্গ পরিমাণ পরিবর্তন-পরিবর্ধন না হয়ে তা সংরক্ষিত থাকবে। কুরআনের এই ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা বিগত চৌদ্দশত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। এ প্রকাশ্য মু'জেযার পর কুরআন আল্লাহ তা'আলার কালাম হওয়াতে কোন প্রকার সন্দেহ -সংশয় থাকতে পারে না।



কুরআনে এলম ও জ্ঞানের যে সাগর পুঞ্জীভূত করা হয়েছে, অন্য কোন কিতাবে আজ পর্যন্ত তা করা হয়নি। ভবিষ্যতেও তা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যারা কুরআনকে জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করেনি, এমন অনেক অ-মুসলিম লোকও কুরআনের এ নযীরবিহীন মু'জেযার কথা স্বীকার করেছেন। কুরআনে যেসব তথ্যাদি বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ তা'আলার বাণী ব্যতীত অন্য কোন বাণীতে তা থাকতে পারে না। সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রই একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, কুরআন আল্লাহ তা'আলারই কালাম এবং মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি সর্বশ্রেষ্ঠ গতিশীল দীর্ঘস্থায়ী মু'জেযা।

লেখকঃ খতীব আব্দুচ্ছালাম বাগেরহাটী, পিলখানা, ঢাকা। 


1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন